'এসিড দগ্ধ মেয়ের গল্প' (চতুর্থ পর্ব)
___সাদিয়া জান্নাত
.
রুহি দুই দিন পর ঢাকায় ফিরে প্রথম অফিসে গেল। রুহিকে প্রবেশ করতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানাল। সবার দেখাদেখি নতুনরাও দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। অন্যদিকে রুহির অনুসন্ধানী দৃষ্টি সেই চারজনকে খুঁজে ফিরছে। দেখল চারজনকে পৃথক পৃথক জায়গায় বসানো হয়েছে। রুহি সোজা স্যারের রুমে গেল প্রথমে।
সাবিহা সিনিয়র একজনকে জিজ্ঞেস করল, এইমাত্র যিনি গেলেন তিনি কে? সে উত্তর দিল, উনি এই কোম্পানির ম্যানেজার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় এতদূর এগিয়ে গেছেন। সিনহা বিস্ময় হয়ে বলল, তাই নাকি! সে বলল, হুম। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই কোম্পানির যেকোনো কাজ, চাই সেটা ছোটখাটোই হোক না কেন এমডি স্যার অবশ্যই ম্যামকে জানিয়ে তারপর করেন। এক কথায় স্যারের মাথার মুকুট বলতে পারেন।
ওরা চারজন শুনে হতবাক হয়ে গেল।
তানিয়া জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা এখানে নাকি মুখ ঢেকে রাখা নিষেধ! তবে ম্যাম কেন ঢেকে রেখেছে?
সে বলল, কোনো এক কারণে ম্যাম স্যারের অনুমতি নিয়েই ঢেকে রেখেছে। স্যার এই ব্যাপারে কথা বলাও নিষেধ করে দিয়েছেন।
দরজায় নক করে রুহি বলল, স্যার আসব?
স্যার বলল, আরে আসো আসো।
: কেমন আছেন?
: ভালো। তোমার কি খবর বলো?
: স্যার কাজটা....!
"স্যার কাজটা কমপ্লিট" এটাই বলবে তাই তো! রুহিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিস্টার রেজা। রুহি মাথা নিচু করে হাসছে। স্যার আবারো বললেন, কোনো কাজের দায়িত্ব তুমি নিয়েছ আর সেটা কমপ্লিট হয়নি এটা হতেই পারে না। এসব বাদ দিয়ে আগে বলো পাঁচ বছরের চুক্তিপত্রে নতুনদের কাছ থেকে সাইন নেওয়ার কারণ কি?
রুহি বলল, স্যার এখন আমাদের কোম্পানি ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। তাই আমাদের ভিতরের খবর নেওয়ার জন্য অন্যরা আমাদের কোম্পানিতে লোক লাগিয়ে দিতে পারে। চাকরির নাম করে সব গোপন তথ্য সংগ্রহ করে দুই তিন মাস পর উধাও। তখন কি হবে ভেবে দেখেছেন?
স্যার গভীর ভাবে চিন্তা করে বললেন, এটা তো কখনো ভাবিনি! সত্যিই অন্য সবার সাথে তোমার তুলনা হয় না। এজন্যই তোমাকে এতটা পছন্দ করি।
রুহি মনে মনে বলছে, যাক এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। "স্যার আসি" বলে নিজের রুমে গেল। জরুরি কাজ সেরে অফিস ছুটি হওয়ার আগেই স্যারকে বলে বাসায় চলে গেল। আজকে ঐ চারজনের সাথে দেখা করল না।
বাসায় পৌঁছতেই মা রুহিকে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করা শুরু করে দিলো। কোথায় ছিলি? কীভাবে ছিলি? নিজের যত্ন তো একটুও নিস না! কেমন চিকন হয়ে গেছিস এই কয়দিনে!
রুহি বলল, আমাকে ট্রিটমেন্ট করার জন্য তো তুমি আছোই তাই না!
রাতে খাবার টেবিলে বসে রুহি খেয়াল করল সে বাদে বাকি সবাই একে অপরের সাথে ইশারায় কি যেন বলছে। রুহি খাওয়া বন্ধ করে বলল, যা বলার বলে ফেলো।
মা: তুই যাওয়ার পর ছেলে পক্ষ থেকে লোক এসেছিল।
রুহি: কোন ছেলে পক্ষ?
মা: তিন বছর আগে যে তিন চারটা ছেলে পক্ষ এসেছিল, তারাই।
রুহি: মা একটা কাজ করো। খাওয়া শেষে সবাইকে ফোন করে বলে দাও কালকে সকাল দশটার মধ্যে আসতে।
"সবাইকে একসাথে কেন?" ভাবী জিজ্ঞেস করল।
রুহি বলল, সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে।
রুহির মা সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দিলো। অন্যদিকে রুহিও স্যারকে জানিয়ে রাখল কাল একটু দেরি হবে যেতে।
সকালে রুহি রেডি হয়ে বসার রুমে এসে দেখে চারটা ছেলে পক্ষ এসেছে। রুহি সালাম দিয়ে বসে পড়ল সামনের সোফায়। রুহির পাশে মা বসেছে আর ভাবী পিছনে দাঁড়িয়ে। রুহি শুরু করল কথা বলা।
রুহি: হঠাৎ কি মনে করে আসলেন আপনারা?
১ম পক্ষের মা: তোমাকে আমার বাড়ির বউ করে নিতে এসেছি।
২য় পক্ষের মা: কে আগে আসছে আর কে পরে সেটা জানি না মা। তবে আমার দাবী কিন্তু একটু বেশি। মনে রেখো।
৩য় পক্ষের মা: এতকিছু বুঝি না। তুমি যখন সবাইকে একসাথে ডাকছ তখন তুমি যা বলবা সেটাই হবে।
৪র্থ পক্ষ ৩য় পক্ষের সঙ্গে একমত।
সবার কথা শুনে রুহি বলল, আজ থেকে তিন বছর আগে যখন আপনারা আমাকে দেখে গেছেন তখন যেমন ছিলাম এখনও ঠিক তেমনি আছি। আমার চেহারা পোড়া ও নষ্ট বলে সেদিন চলে গেলেন সবাই। আজ তিন বছর পর আবার এসেছেন সেই পোড়া চেহারার মেয়েকে বউ করে নিতে! বুঝলাম না এর রহস্য কি?
২য় পক্ষের মা মুখে একটু হাসি টেনে বলল, সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে না!
এবার রুহি বলল, ওও হ্যাঁ। তখন তো ছিলাম কর্মহীন, বেকার, মুখ-পোড়া একটা মেয়ে যার ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। আর এখন তো আমি টাকার কুমির তাই না! তখন আপনাদের কাছে ছেলেদের জন্য মেয়ের চেহারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর এখন মেয়ের টাকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!
রুহির মা বলল, এসব কি বলছিস তুই?
রুহি বলল, মা তুমি চুপ করে থাকো।
২য় পক্ষ: এভাবে আমাদেরকে অপমান করার মানে কি?
রুহি: এখানে তো শুধু আপনারাই। তবু অপমান বোধ করছেন? আর তিন বছর আগে যখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ের কথা বলে চলে যাওয়ার পরে আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি। যখন পুরো এলাকা আপনাদের এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদেরকে কথা শোনাল তখন আমরা কি অপমানিত হইনি?
৪র্থ পক্ষ: সেদিনের জন্য সরি।
রুহি: সেই সময় প্রতিটি মুহূর্তে আমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে এসেছি আর আজ আপনি সরি বলছেন!
একটু থেমে আবার বলল, এই তিন বছরেও আপনাদের ছেলেদেরকে বিয়ে কেন করান নাই? ওও, টাকাওয়ালী মেয়ে জোটেনি তাই!
১ম পক্ষ: আসলে....!
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুহি বলল, আসল নকল কিছু বুঝি না। আজকের পর থেকে যেন আপনাদেরকে এই বাসার আশেপাশে না দেখা যায়। যারা স্বার্থলোভী, অর্থলোভী তাদেরকে দেখতে চাই না। এবার সবাই আসতে পারেন।
সবাই মাথা নিচু করে চলে গেল। রুহির মা রুহিকে ধমক দিয়ে বলল, এটা কি করলি তুই? এতদিন পর তোর বিয়ের কথা নিয়ে এসেছে আর তুই তাদেরকে অপমান করে বিদায় করলি? ভাবী রুহির পক্ষ হয়ে বলল, রুহি যা করেছে একদম ঠিক করেছে মা। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেন আপনিও বুঝতে পারবেন।
এবার রুহি ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলো।
.
(চলবে...!)
0 Comments