'এসিড দগ্ধ মেয়ের গল্প' (দ্বিতীয় পর্ব)
___সাদিয়া জান্নাত
.
রুহি বলা শুরু করল।
"আমার পরিবারের সদস্য বলতে বাবা, মা, বড় ভাই, ভাবী, ভাতিজি আর আমি। সুখী পরিবার যাকে বলে। ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে আমি একটু বেশি সুন্দর ছিলাম বলে নিজের বান্ধবীরাও মনে মনে হিংসা করত যা আমি পরে বুঝতে পারি। অথচ আমি ছিলাম একদম মিশুক প্রকৃতির মানুষ। কখনও প্রেম করিনি তবে একজনের সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগতো। তাকেও বলিনি কখনো। উপরওয়ালা সৌন্দর্যের পাশাপাশি মেধাও দিয়েছিলেন। তাই সব ছেলেমেয়েরাই লেখাপড়ার বিষয়ে হেল্প নেওয়া থেকে শুরু করে গল্প-গুজব সহ সব বিষয়েই আমার কাছে ভীড় করত। এমনও হত যে জুনিয়র ছাত্ররাও আমার কাছে নোট ঠিক করতে আসত। সেজন্য ক্যাম্পাসের সব মেয়েদের সাথে সাথে নিজের বান্ধবীদের কাছ থেকেও হিংসার শিকার হতে থাকলাম। মেধা ও সৌন্দর্যের জন্য উপরওয়ালার কাছে আমি শুকরিয়া আদায় করব নাকি আফসোস করব! দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলাম যেন। অন্য মেয়েদের কথা বাদই দিলাম। নিজের বান্ধবীগুলো যাদের সবসময়ই নিজের বোনের মত ভাবতাম, তাদের হিংস্র থাবা যে এতটা ভয়ংকর হবে কখনও সেটা ভাবিনি।"
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল রুহি। স্যার টেবিলে রাখা পানির গ্লাস রুহির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। পানিটুকু পান করে আবার শুরু করল সে।
"ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আমরা সবাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা জায়গায় কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু তারা যে আগেই আমার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করে রেখেছিল সেদিন সেটা কল্পনাও করিনি। আমরা চার বান্ধবী। একজনের কাজ আছে বলে আগেই চলে গেছে। আরেকজনের একটু দেরি হবে বলে আমাদের দুজনকে আগে যেতে বলল। অন্যজন আমার সাথে কিছুদূর গিয়ে বলল, তুই গিয়ে ওখানে বস আমি আসছি। আমি ওখানে গিয়ে বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা কেউই আসছে না। হঠাৎ অপরিচিত দুইটা ছেলে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ব্যপারটা খারাপ দেখায় ভেবে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ওদের একজন আমার মুখের উপর এসিড নিক্ষেপ করেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। এই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগে। আমার সামনে সবাই সমবেদনা প্রকাশ করলেও আমার পিছনে বলে 'ঠিকই হয়েছে'!সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম যখন আমার বান্ধবীদেরকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখলাম। তখন সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। নিজেদেরকে নির্দোষ রাখার জন্য অন্যকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেয় তারা। তারপর থেকে আর ওদের সাথে সম্পর্ক রাখিনি। সুস্থ হবার পর দুই দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে সবার হাসির পাত্র হলাম, বিশেষ করে মেয়েদের। তারপর নিজেকে একরকম ঘরে বন্দি করে রাখলাম। এক একটা মুহূর্ত যেন নিজেই নিজের সাথে বাঁচা-মরার লড়াই করে যাচ্ছিলাম। ভাইয়া ভাবী অনেক বোঝালেন যেন অঘটন কিছু না ঘটাই। বাবা স্যারদের সাথে কথা বলে বাসা থেকেই পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এতকিছুর পরও আমার নাম সবার উপরে দেখে নিজের প্রতি একটা আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। এই দুর্ঘটনার আগে অনেকেই আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। এখন তারা বাসার ছায়ায় পা দেওয়া তো দূরের কথা, ফোনটা পর্যন্ত ধরে না। যে ছেলের সাথে কথা বলতে ভালো লাগত সে ভদ্রতার খাতিরে শুধুমাত্র একদিন দেখতে এসেছিল। সেটাও পনেরো কি বিশ মিনিটের জন্য। যে কিনা আগে বিনা কারণেই সারাদিনে ৭/৮ বার ফোন দিত, সে ই সেদিনের পর থেকে আর কখনো ফোন দেয়নি। তাই আমিও দিইনি। তখনই ঠিক করলাম নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত অন্যকিছু নিয়ে ভাবব না। স্যার, আপনি শুনলে হয়তো অবাক হবেন এতদিনে অগনিত জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। সবগুলো জায়গাতেই চেহারা দেখেই বাদ দিয়েছে।দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চায়নি। এই প্রথম আপনি আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন।
স্যার: আপনার বান্ধবীদের ব্যপারে আইনী ব্যবস্থা নেননি?
রুহি: না স্যার। ওদেরকে ওদের তকদীরের উপর ছেড়ে দিয়েছি। এর শাস্তি ওরা একদিন না একদিন অবশ্যই পাবে।
কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব। নীরবতা ভেঙে রুহি কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে বলল, আজকে তিনটা জায়গায় ইন্টারভিউ ছিল। সকালে একটা দিয়ে এখানে এসেছি। আরও একটা বাকি আছে। আজ মনে হয় সেটা দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে একটা কথা স্যার, মনের অব্যক্ত কথাগুলো কাউকে বলতে পেরে এখন নিজেকে খুব হালকা লাগছে। মনের উপর থেকে বিরাট একটা বোঝা নেমে গেল যেন। এখন ঘুমিয়েও শান্তি পাব মনে হচ্ছে। আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।
স্যার চুপচাপ বসে আছেন। রুহি আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল 'আসি স্যার, ভালো থাকবেন'। দরজায় হাত দেওয়ার আগেই স্যার পিছন থেকে ডাকলেন, মিস রুহি, বসুন একটু।
রুহি ফিরে এসে আবার বসল।
স্যার: আমার কাছের কেউ একজন বলেছিল 'কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে মোটেও বিলম্ব করা ঠিক নয়'। কথা সত্য। আপনি সিলেক্টেড। কাল থেকে আপনার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।
.
(চলবে....!)
0 Comments