'এসিড দগ্ধ মেয়ের গল্প' (তৃতীয় পর্ব)
___সাদিয়া জান্নাত
.
নিজের কানকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না রুহি। চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না। অতি খুশিতে যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। শুধু করজোড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
স্যার বললেন, মিস রুহি আপনি যদি বুদ্ধি খাটিয়ে ইন্টারভিউ এর আগে চেহারা দেখা থেকে বিরত না করতেন তাহলে আমিও বাকি সবার মত অনেক বড় একটা ভুল করে বসতাম।
"MR" গ্রুপ অব কোম্পানিতে আপনাকে স্বাগতম মিস রুহি!
রুহি আর কোনো কথা বলতে পারল না। শুধু যাওয়ার আগে বলল, স্যার আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ, আমার এই চেহারা কারো সামনে প্রকাশ করতে চাই না। তাই আমি সবসময়ই চেহারা ঢেকে আসতে চাই। আশা করি আমার অপারগতা বুঝতে পারছেন!
স্যার বললেন, সেটা বলতে হবে না। তবে একটা কথা আগেই জানিয়ে দিচ্ছি, আপনি যদি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন তাহলে বিশেষ সারপ্রাইজের জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
আজকে রুহির খুশির শেষ নাই যেন। শেষ কবে এতটা খুশি হয়েছিল সেটা এই মুহুর্তে তার মনে পড়ছে না। অফিস থেকে বের হয়ে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে সোজা বাড়ি গেল। রুহির হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখে সবাই প্রথমে অবাক হলো। "আমি ইন্টারভিউতে টিকে গেছি" বলতেই সবাই এসে জড়িয়ে ধরল। আজ অনেক দিন পর একসাথে সবাইকেই হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে। রুমে এসে রুহি দুই রাকাত নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করল। রাতে রুহি শুয়ে শুয়ে আজকের কথা ভাবছে, অবশেষে উপরওয়ালা আমার প্রতি সুদৃষ্টি দিয়েছেন।
পরদিন সকালে রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল রুহি। অফিসে পৌঁছে প্রথমে এমডি স্যারের সাথে দেখা করল। স্যার তার পিএ'কে ডেকে রুহির সিট দেখিয়ে দিতে বললেন। রুহি তার পিছু পিছু এসে নিজের সিটে বসল। রুহিকে বোরকা পরিহিত অবস্থায় দেখে সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলাবলি করছে। সিনিয়র একজন তার কাছে এসে বলল, এখানে মুখ ঢেকে রাখা নিষেধ সেটা জানেন না! রুহি চুপচাপ বসে আছে। পিছন থেকে এমডি স্যার বললেন, আমার অফিসে কোনটা নিষেধ আর কোনটা নিষেধ নয় সেটা আমি দেখছি। আপনি আপাতত আপনার সিটে বসে পড়ুন। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, ইনি মিস রুহি। আমাদের নতুন স্টাফ। উনি বিশেষ কারণে অনুমতি নিয়েই চেহারা ঢেকে রেখেছেন। এটা নিয়ে আর কোনো কথা নয়। সুতরাং এখন যে যার মত কাজ করুন।
দুই বছর যেতে না যেতেই কোম্পানির সুনাম এখন বাইরের দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। সুনামধন্য কোম্পানিগুলোর কাতারে এখন "MR" কোম্পানিও শামিল।
এক প্রেস কনফারেন্সে "MR" কোম্পানির এমডি মিস্টার মাহমুদ রেজা'কে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল' মিস্টার রেজা, মাত্র দুই বছরের মধ্যে এত সাফল্যের পিছনে কারণ কি?' তখন মিস্টার রেজা হেসে বললেন, পরশ-পাথরের নাম শুনেছেন তো, যার স্পর্শে লোহাও সোনা হয়ে যায়! আমি দুই বছর আগে একটা পরশ-পাথরের সন্ধান পেয়েছি, যার বিনিময়ে আজ আমার কোম্পানি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সেই 'পরশ-পাথর'কে মিডিয়ার সামনে আনার অনুরোধ জানানো হলে তিনি বলেন, নিজের মূল্যবান সম্পদ কি কেউ সবার সামনে প্রকাশ করে!
মিস্টার রেজা রুহির দক্ষতার পরিচয় প্রথম মাসেই পেয়েছিলেন। কীভাবে সে সেদিন মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে দেড় কোটি টাকার প্রজেক্টকে আড়াই কোটিতে পরিবর্তন করে সেটা ক্লাইন্টদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়ে ডিল ফাইনাল করল, সেটা যেন এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয় মিস্টার রেজার কাছে। তারপর থেকে বড় থেকে ছোটখাটো বিষয়ও রুহির পরামর্শ ছাড়া করেন না।
একদিন রুহি অফিসে এসে নিজের জায়গা ফাঁকা দেখে অবাক হয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করল, আমার সিট কোথায়?
সে বলল জানি না। সে স্যারের রুমে যেতেই স্যার বলল, এসেছ! আমি তো তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। চলো আমার সাথে।স্যার রুহিকে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুহি দেখল রুমটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। স্যার দুই হাতে রুহির দুই বাহু ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার মনে আছে একবার সারপ্রাইজের কথা বলেছিলাম! এটাই সেই সারপ্রাইজ। আজ থেকে তুমি এই কোম্পানির ম্যানেজার। এই রুম তোমার জন্য। রুহি দ্বিতীয়বার খুশিতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। মিস্টার রেজা বাইরে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজ থেকে মিস রুহি এই কোম্পানির ম্যানেজার। সবাই রুহিকে অভিনন্দন জানাল।খবরটা বাসায় দিতেই আরও একবার খুশির বন্যা বয়ে গেল পরিবারে।
অফিসের কাজে তিনদিন হলো রুহি ঢাকার বাইরে। আরও দুই একদিন থাকতে হবে মনে হয়। এর মধ্যে স্যারের পিএ ফোন করে বলল, ম্যাডাম আপনার ইমেইল চেক করেন। নতুন সিলেক্টড ছয়জনের বায়োডাটা পাঠিয়ে দিয়েছি। রুহি 'আচ্ছা' বলে রেখে দিলো। ইমেইল চেক করতে গিয়ে সাবিহা আর রুনার নাম দেখে রুহি কিছুটা চমকে উঠল। এরা সেই চার বান্ধবীদের দুজন। রুহি ফোন করে বলল যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল সবগুলোর বায়োডাটা পাঠিয়ে দিন। সবগুলো চেক করে দেখে মনে মনে বলল, যা ভেবেছিলাম সেটাই হয়েছে। ওরা চারজন একসাথেই এসেছিল ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু দুজন টিকেছে শুধু। আবারো ফোন করল রুহি।
: হ্যালো ম্যাম বলেন।
: আচ্ছা এদের ইন্টারভিউ কবে নেওয়া হয়েছে?
: আজ দুপুরে ম্যাম।
: যাদেরকে সিলেক্ট করা হয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে কি?
: না ম্যাম। স্যার প্রথমে আপনাকে দেখাতে বলেছেন। তারপর আপনি যা বলবেন সেটাই করতে বলছেন।
: ওও আচ্ছা। এক কাজ করুন, যারা সিলেক্ট হয়নি তাদের মধ্যে দেখেন সিনহা আর তানিয়া নামে দুজন আছে। ওদেরকেও লিস্টে যোগ করে দিন।
: আচ্ছা ম্যাম।
: আরেকটা কাজ করবেন। স্যারকে বলবেন, তিনি যেন ওদের কাছ থেকে একটি চুক্তিপত্রে সাইন করে নেন যেখান উল্লেখ থাকবে পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো কারণেই তারা এই কোম্পানি ছেড়ে দিতে পারবে না। বুঝতে পেরেছেন? আর স্যার এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমি এসে সব বুঝিয়ে দিব।
ফোন রেখে দিয়ে রুহি মনে মনে ভাবছে, এবার শুরু হবে আসল খেলা!
.
(চলবে....!)
0 Comments